কলকাতা: নিজের ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছেন তারিখটা। ডায়েরি লেখা নিত্য অভ্যাস কলকাতা ময়দানের প্রখ্যাত প্রাক্তন তারকা নারায়ণস্বামী উলগানাথনের।
২৪ জুলাই, ১৯৭৬ সাল। কলকাতা লিগে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মধ্যে ম্যাচ।
উলগা খেলছিলেন মোহনবাগানের হয়ে। সেন্টার লাইনে হাবিব বল বসিয়ে বলটি দিলেন উলগাকে, আর সেই বল ধরে আলতো থ্রু উলগা দিলেন আকবরকে, সেই বল জালে জড়িয়ে দিতে লেগেছিল মাত্র ১৩ সেকেন্ড।
ওই মহানজিরের অন্যতম কারিগরকে শুক্রবার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রীড়া দপ্তরের পক্ষ থেকে তুলে দেওয়া হল বাংলার গৌরব সম্মান।
ভারতীয় ফুটবলে ওই ঘটনা সোনায় লেখা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। কেউই সেই মহানজির ভাঙতে পারেননি।
এত নামী এক তারকাকে কেন বিলম্ব হল স্বীকৃতি জানাতে জানালেন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার কমিটির অন্যতম কর্তা প্রাক্তন ফুটবলার তথা উলগানাথনের সতীর্থ মানস ভট্টাচার্য, “এই সম্মান উলগাকে ঠিক সময়েই দেওয়া হয়েছে । কেননা উলগা তো ভিনরাজ্যের ফুটবলার ছিলেন। সেই কারণেই আমরা ওঁর নাম এবারের জন্য বিবেচিত করেছিলাম। কারণ আগে আমাদের এই রাজ্যের ফুটবলারদের এই স্বীকৃতি দিতে হবে। তারপর বাইরের রাজ্যের।’’
ভারতীয় ফুটবলে উলগানাথন মানে অনেককিছুই। তিনি ছিলেন কালো মানিক। তাঁর মতো উইঙ্গার দেশের ফুটবলে বিরল।
উলগানাথনের পুরস্কার প্রাপ্তির কথা শুনে তাঁর একদা সতীর্থ নামী ডিফেন্ডার সুব্রত ভট্টাচার্য্য জানালেন, ‘‘উলগা বেঙ্গালুরুর হতে পারে, কিন্তু আমি তো শুনেছি ওঁর কলকাতাতেও বাড়ি রয়েছে। উলগার কথা আগে ভাবলে ভাল হতো। তবে ওঁর ড্রিবলিং ও পাসিং দারুণ ছিল। দুটি উইংয়ের খেলতে পারত। রাইটউইংয়ে বেশি কার্যকরি ছিল। আমি ওর বিরুদ্ধে খেলেছি, ওকে আটকানো কঠিন ছিল। কারণ জায়গা বদল করে খেলতে পারত।’’
কলকাতায় এসেছিলেন শৈলেন মান্নার ডাকে। সেইসময় মান্না ছিলেন মোহনবাগানের ক্লাবের ফুটবল সচিব। অলিম্পিকের যোগ্যতা পর্বের শিবির চলছিল।
মান্না নিজে গিয়ে স্পট করে উলগানাথনকে মোহনবাগানে নিয়ে আসেন। সেটি ১৯৭৪ সাল হবে। উলগার আরও এক বন্ধু বিদেশ বসুও জানালেন, ওঁর খেলার স্টাইল অদ্ভুত ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সারা মাঠকে দেখে নিয়ে পাস দিতে পারত। এতো ভাল পাসার ভারতীয় ফুটবলে আসেনি।
মানস অবশ্য উলগার গোল করার মুনশিয়ানার কথাও জানালেন। ‘‘সবাই বলে উলগা ছিলেন ভাল পাসার, সেটি অবশ্যই সঠিক। কিন্তু ওঁর মতো গোলগেটার খুব কম ছিল। ১৯৭৬ সালের ডুরান্ডের দিল্লিতে জেসিটি-র বিপক্ষে হ্যাটট্রিক ছিল ওর। আমরা সেবার দশবছর পরে ফেড কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
উলগার বিপক্ষে খেলা লাল হলুদ ডিফেন্ডার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য একটি বিশেষ গুণের কথা জানালেন। ‘‘আমার বেশ মনে রয়েছে ১৯৭৯ সালের লিগ ম্যাচে উলগাদাকে আমি আটকে দিতে মাথা গরম করে আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। আর সেই কারণে ওই ম্যাচটিতে উলগাদা হলুদ কার্ড দেখেন। ১২ বছরের ফুটবল জীবনে মাত্র ওই একবারই তিনি কার্ড দেখেছিলেন। এতোই ঠান্ডা মাথার ফুটবলার ছিলেন।’’
মনা জানালেন, ‘‘আমি যতবার দেখেছি উলগাদা-কে মারতেন বিপক্ষের ডিফেন্ডার, কিন্তু উনি রাগ করতেন না।’’
শুক্রবার উলগানাথনের সঙ্গে তাঁর একদা সতীর্থ ময়দানের আরও এক নামী ফুটবলার দিলীপ পালিতকেও বাংলার গৌরব সম্মান দেওয়া হয়েছে। দিলীপের ভাইঝি আরতিকেই বিয়ে করেন উলগা। দিলীপও অনুষ্ঠান মঞ্চে জানান, ‘‘আমার ভাল লাগছে উলগার মতো নামী তারকাকে মনে করেছে এখানকার মানুষেরা। আমিও খুব খুশি।’’