কলকাতা: মাত্র ৩৮ বছর বয়সে অভিষেক ডালমিয়া ক্রিকেট এসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের (সিএবি) সভাপতি পদে বসেছেন। এত কম বয়সে এর আগে কেউ শীর্ষ পদে আসিন হতে পারেননি।
অনেকেই মনে করেন, প্রাক্তন বোর্ড সভাপতি প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার পুত্র বলেই তাঁর কাজটি সহজ হয়েছে। কঠিন কোনও পরীক্ষার সামনে তাঁকে পড়তেই হয়নি। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ ছিল না। কারণ সিএবি-র সভাপতির চেয়ারে ফুলও যেমন বিছনো থাকে, পাশাপাশি থাকে কাঁটাও। তাই একটু ভুল হলেই চারিদিক থেকে সমালোচনার স্রোতে ভেসে যেতে পারতেন তিনি।
সেটি তো হয়ইনি, উপরন্তু অভিষেকের কাজের ধরণ নিয়ে বাংলা ক্রিকেটে প্রশংসার বাতাবরণ। এত কম সময়ে তিনি যেভাবে গুছিয়ে কাজ করছেন, তাতে মনেই হবে ক্রিকেট প্রশাসনের রক্ত তাঁর ধমনীতে বইছেই। প্রথমে রাজস্থান ক্লাবের দেখভাল থেকে শুরু, তারপর বাবার ছায়াসঙ্গী হিসেবে ব্যাক অফিস কাজ তাঁকে অভিজ্ঞ করে তুলেছে। তাঁকে শিখিয়েছে প্রশাসনিক নানা খুঁটিনাটি।
সিএবি সভাপতি হওয়ার পরে এত দীর্ঘ সাক্ষাৎকার এই প্রথম দিলেন তিনি। সেখানে কিংবদন্তি বাবার কথা যেমন এসেছে, তেমনি স্বাভাবিকভাবেই বলেছেন সৌরভ গাঙ্গুলির কথাও। নিজের ইচ্ছের কথাও জানিয়েছেন। অকপটে সিএবি সভাপতির ঘরে বসেই জানালেন KHEL UPDATES -কে।
প্রশ্ন : এত কম সময়ে এত বড় দায়িত্ব মাথায় চলে আসবে, কোনওদিন ভেবেছিলেন?
অভিষেক : সত্যিই ভাবিনি, হয়তো আমার ললাট লিখনে ছিল। একেই মনে হয় বলে ডেসটিনি, ভবিতব্য। আমার ক্রিকেটে আসাটা পরিকল্পিত, আমি বলব না। তবে কিছু ক্ষেত্রে বাবা আমাকে দিয়ে কিছু কাজ এমনভাবে করিয়েছিলেন, এখন বুঝতে পারি কাজটি হয়তো তিনিই ভেবেই করেছিলেন। আমি প্রথম ময়দানে পা রাখি রাজস্থান ক্লাবের দেখভালের মাধ্যমে। সেইসময় রাজস্থান রেলিগেশন ফাইনাল খেলছিল। তার কয়েকবছর আগে পর্যন্ত রাজস্থান রেলিগেশন ফাইট করছিল। আমি দায়িত্ব নিয়ে ভাবলাম এবার দলটিকে একটু ভাল করা যেতে পারে। সেই মতো দলগঠন করার দায়িত্ব গ্রহণ করি। এবং সফলও হই।
আমি বাবার সঙ্গে ক্রিকেটের বিষয়ে কাজ করতাম। বাবার ক্রিকেটের প্রশাসনিক বিষয়ের ব্যাক অফিস কাজের দায়িত্বে ছিলাম। দেখেছি কিভাবে তিনি কাজ করছেন। আমার জন্মের আগেই বাবা ১৯৭৯ সালে সিএবি-তে প্রথম কোষাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। জন্মের পর থেকেই আমাদের বাড়িতে ক্রিকেট নিয়ে কথা হতো। শুধু সপ্তাহে একটা-দুটি দিন নয়, বরং প্রতি সন্ধ্যাতেই ক্রিকেট নিয়ে নানা বিষয় আলোচনা হতো। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের পরিবারের প্যাশন ছিল ক্রিকেট। সেই কারণে সিএবি-র প্রতিষ্ঠা দিবসে কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাব বনাম সিএবি একাদশের মধ্যে ম্যাচে বাবা যখন ব্যাটিং করতে নেমে চার মারতেন, ভাল লাগত, খুশি হতাম। তারপর আমি বাবাকে যথাসম্ভব প্রশাসনিক বিষয়ে সাহায্য করেছিলাম, তিনি যখন ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি আইসিসি ও বিসিসিআই-তে পদে ছিলেন। তখন তাঁর নানা কাজই আমাকে করতে হয়েছে।
একটা সময় তাঁর যখন আইনি-মামলা মকদ্দমার নানা বিষয় চলছিল, তখন আমাকে কোর্টে যেতে হয়েছে টানা ৪৫ থেকে ৫০ দিন। আইনি বিষয়গুলি তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন। তাই ক্রিকেট ও ক্রিকেটের বাইরে সেই সম্পর্কিত নানা বিষয় সম্পর্কে একটা স্পষ্ঠ ধারণা হয়ে গিয়েছিল।
তারপর আমি সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি চারবছর। তাঁর পাশে থেকে খুঁটিনাটি বহু বিষয় শিখেছি। আমি আসার আগে সিএবি-র কোনও কমিটিতেও ছিলাম না। কিন্তু প্রশাসনে আসার আগে নানা বিষয় নিয়ে স্বচ্ছ একটা ধারণা আগে থাকায় অসুবিধে কিছু হয়নি।
প্রশ্ন :পারিবারিক ব্যবসা না ক্রিকেট প্রশাসন, আপনাকে কোনটিকে বেশি ভাবিত করেছিল?
অভিষেক : আমার মনে হয় দুটোই। কেননা ক্রিকেট আমাদের প্যাশন হলেও আমাদের রুটিরুজি হলো আমাদের ব্যবসা। বানতলায় আইটি পার্ক আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হয়েছে। তবে শুরুতে তো ক্রিকেটের প্রশাসনিক বিষয় অতটা বুঝতাম না। ধীরে ধীরে বুঝেছি। সেইসময় ব্যবসাই দেখতে হতো। তবে বাবা আমাকে প্রতিদিন অফিসে ডেকে বাকিরা কী কাজ করছেন, দেখতে বলতেন। এবং এই কাজটি ছিল প্রতিদিন। তাই স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি আমার ভাল লাগত না। শুধু ভাবতাম, বাকিরা কে কী করছে, সেই কাজটি দেখাই আমার কাজ। আর যে কাজগুলি হয়ে গিয়েছে, তার পেপারগুলি পড়া ছিল আমার কাজ। মনে মনে খারাপ লাগত। শুধু ভাবতাম, তা হলে আমার কী কোনও আলাদা কাজ নেই।
বয়স সেইসময় অল্প ছিল। তাই অতটা বোঝার বয়স হয়নি। কিন্তু পরে বুঝেছি কোনও বিষয় বুঝতে গেলে তার তৃণমূল স্তর থেকে কাজটা শিখতে হয়। সেটি আমাকে বাবা ওর মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন। যদিও দিনের শেষে ক্রিকেটের কাজ করতে পারলে মনটা ভাল হয়ে যায়। এটা যেহেতু সাম্মানিক পদ, তাই সারাদিনের ক্লান্তি উধাও হয়ে যায় ক্রিকেটের কাজ করতে পারলে।
প্রশ্ন : মা-বাবা কী চেয়েছিলেন?
অভিষেক : আমার বাবা-মা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন পেশাগতভাবে কী করতে চাই। কোনওদিনই জোর করেননি। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমি ক্রিকেটটা ভালই খেলতাম। বাবা অবশ্য বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন সিরিয়াসভাবে ক্রিকেটটা না খেলি। কারণ ক্রিকেট খেলার সময় বাবা বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন, সিএবি-রও তিনি শীর্ষ পদে বিরাজ করছেন। তাই আমি কোনও কারণে সুযোগ গেলে বিষয়টি স্বার্থের সংঘাত হিসেবে দেখা হতো। বলা হতো, বাবা প্রভাবশালী বলেই আমার সুযোগ সহজে হয়েছে। আমার দক্ষতার বিষয়টি প্রাধান্য পেত না।
আবার এও ঠিক, যদি কোনও কারণে খারাপ খেলতাম, তা হলে বলা হতো বাবা বোর্ডের প্রভাবশালী পদে থেকেও সেই সুবিধেটা আমি নিতে পারলাম না। সবদিক থেকেই বিষয়টি আমাদের নাড়া দিত। তাই বাবা চাননি আমি সিরিয়াস ক্রিকেট খেলি।
ক্রিকেট প্রশাসনে দিতে চেয়েছিলেন যদিও, না হলে কেনই বা আমাকে আমাদের পারিবারিক ক্লাব রাজস্থানের দায়িত্ব দিতেন। তিনি বলতেন দলগঠনটা নিজের হাতে সারতে। তাই উনি হয়তো ভেবেই রেখেছিলেন বিষয়গুলি।
প্রশ্ন : সৌরভ বলেছিলেন আপনি হলেন সিএবি-তে গাঙ্গুলির রাহুল দ্রাবিড়, ওই কমপ্লিমেন্ট কী আপনাকে বাড়তি মোটিভেট করেছিল?
অভিষেক: অবশ্যই করেছিল। সৌরভ গাঙ্গুলি আন্তর্জাতিকমানের একজন আইকন। তাঁর মুখ থেকে এমন কথা শুনে কাজের ইচ্ছে আরও বেড়ে যায়। তার থেকেও বড় কথা, তাঁর সঙ্গে আমি চারবছর টানা কাজ করেছি। তিনি কিভাবে বিষয়গুলিকে সামলেছেন, আমি সামনে থেকে দেখেছি। এটা আমার কাছেও বিশেষ প্রাপ্তির। হয়তো পূর্বজন্মে কোনও ভাল কোনও কাজ করেছি, সেই কারণে গাঙ্গুলির সান্নিধ্য পেয়েছি।
যেহেতু আমি বাবার পাশে থেকে প্রশাসনিক কাজগুলি ব্যাক অফিস থেকে সামলেছি। তাই সৌরভ যখন কাজগুলি কার্যকরি করছিলেন, সেগুলি আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, স্বাধনীনভাবে আমাকে নানা কাজ দিয়েছেন, এটা সবাই দেয় না।
প্রশ্ন: প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়াকে কাজ করতে দেখেছেন, আর গাঙ্গুলির সঙ্গে তো কাজই করেছেন। দুই বড়মাপের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজের মৌলিক বিচার করতে বললে কী জানাবেন?
অভিষেক : দুইজন দুইরকমের ব্যক্তিত্ব, তাঁদের কাজের ধরণও আলাদা। তবে দুইজনই সিএবি ও ভারতীয় ক্রিকেটের কঠিন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছেন।
বাবা যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেইসময় বোর্ডে সেরকম অর্থ ছিল না। ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কম ছিল। টিভি রাইটসের বিষয় যেমন ছিল, তেমনি আইসিসি-তে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অবস্থান তেমন শক্তিশালী ছিল না। তিনি বিসিসিআই-তে বসে ক্রিকেটের গ্লোবালাইজেশন এনেছিলেন। বোর্ডে বহু মানুষের চাকরি হয়েছে। বোর্ড আয়ের দিক থেকে লাভবান হয়েছে।
মহারাজদা-র ক্ষেত্রেও একই বিষয়। উনি যখন সিএবি-র দায়িত্ব নিলেন, সেইসময় লোধা সংস্কারের কাজ চলছিল। কী হবে, কী হতে পারে, তার কোনও ধারনাই ছিল না কারোরই। নতুন পলিসি এসেছে, বোর্ড থেকে টাকা আটকে গিয়েছিল। ওঁর জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতেন, তা হলে কাজটি সহজ হতো না।
প্রশ্ন: কিংবদন্তির সন্তান হওয়া সবসময় চাপের। এই নিয়ে আপনিও চাপ অনুভব করেন?
অভিষেক : আমার এই নিয়ে কোনও চাপ নেই। যখনই আমি নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করব, সেদিন থেকেই নিরন্তর চাপ আসতে থাকবে। তাই উনি যা শিখিয়েছেন, যা শিখিয়ে গিয়েছেন, সেটাকে নিজের মতো করে বাস্তবায়িত করাটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জের।
প্রশ্ন : আপনি মিস্টার ডালমিয়াকে নানা সমস্যার মধ্যেও পড়তে দেখেছেন। তিনি কিভাবে বিষয়গুলিকে ট্যাকল করতেন?
অভিষেক : উনি এসব ব্যাপারে কোনও সময়ই বিচলিত হতেন না। প্রশাসক জীবনে বহুবার নানা সমস্যা এসেছে, কেউ তার আপন মানুষ বিরোধিতা করেছেন। তাই নিয়ে প্রশ্ন করতে বাবা বলতেন, এটাই আমার কাছে প্রত্যাশিত। আর যারা বিরোধিতা করছে, তারাও বোর্ডে বহুদিন ধরে কাজ করছেন, তাদের সেই বলার অধিকার রয়েছে। আর সব বিষয়ে অত ভাবলে কাজ করা চলে না। যদি কেউ মিথ্যে অভিযোগ করতেন, তিনি বলতেন, সেখানে আইনি পথে তার বিরোধিতা করতে হবে। যাতে করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা যায়। কিন্তু উনি একটা বিষয়ে আমাকে জানাতেন, কেউ যদি দুঃসময়ে পাশে থাকে, তাকে যেন কোনওদিন না ভুলি। এটা তাঁর জীবনের আদর্শ ছিল, আমারও তাই।
প্রশ্ন : এবার বাংলা রঞ্জি দলে কম বিতর্ক হয়নি। অশোক দিন্দা, সুদীপ চ্যাটার্জিদের মতো সিনিয়রদের বাদও দিতে হয়েছে। কিন্তু শিবিরের পরিবেশের বদল হয়নি। এমনকি এত বিতর্কের পরেও দলের অন্দরে বন্ধুত্বপূর্ণ বাতাবরণ থেকে গিয়েছে, এর কারণ কী?
অভিষেক: একটা বড় দলে বিক্ষিপ্ত নানা ঘটনা ঘটতেই থাকে। এগুলিকে আমরা নিরিক্ষণ করে নিজেদের মতো সমাধানের পথ খুঁজেছি। আমরা ফিরিয়ে এনেছি অরুণলাল, উৎপল চ্যাটার্জিদের মতো অভিজ্ঞ প্রাক্তন তারকাদের। ক্রিকেটারদের সঙ্গে কর্তাদের মানসিক ব্যবধান কমিয়ে দিতে পেরেছি, আমার মনে হয় এতে করে কাজ হয়েছে।
বাংলা ক্রিকেট নিয়ে কম কাজ আমাদের হয়নি। নতুন করে সংস্কারের কাজ চলছে। লিগ ক্রিকেটের ফরম্যাট বদল হয়েছে, বড় মাঠে খেলা হচ্ছে। বয়স ভাঁড়ানো রুখতে পৃথক সেল খোলা হয়েছে। বোন ডেনসিটি টেস্ট শুরু হয়েছে। ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফদের আচরণবিধি চালু হয়েছে। ইডেনের ইন্ডোর স্টেডিয়ামকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্নীতির বিষয়ে সজাগ হওয়া গিয়েছে। অবজার্ভার নিয়োগ হয়েছে ছোট ম্যাচের জন্য।