কলকাতা : রাজ ও মহারাজ। দু’জনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছয়বছরের। একজন ১৯৮৭ সালে বাংলার হয়ে অভিষেক ম্যাচ খেলেছিলেন। অন্যজন বাংলার হয়ে প্রথম মাঠে নামেন ১৯৮৯ সালের রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে। দাদা স্নেহাশিস গাঙ্গুলির জায়গায় মাঠে ওই ম্যাচে দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন ভাই সৌরভ।
সেই ঘটনা নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যায় বাংলা ক্রিকেটে কান পাতলে। আসল ঘটনা কী ছিল, সত্যিই কী সেদিন রাজ অর্থাৎ স্নেহাশিসকে দল থেকে অন্যায়ভাবে বাদ যেতে হয়। কতরকম রটনা ছিল, সব বিতর্ক দূরে সরিয়ে দাদাই জানালেন আসল ঘটনা।
সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নানা বিষয়। প্রশাসক সৌরভ কিংবা ক্রিকেটার সৌরভ কেমন ছিলেন, তিনি কতটা ব্যতিক্রমী। নিজের সিএবি-তে সচিব পদের মতো হটসিটে বসার অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে অন্য মেজাজে ধরা দিলেন স্নেহাশিস। তাঁর সঙ্গে KHEL UPDATES এর সাক্ষাৎপর্ব মিটল, তখন প্রায় রাত সাড়ে দশটা নাগাদ। সেইসময় সিএবি সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা ঘরেই শুধু আলো জ্বলছে, সেটি সৌরভের দাদার চেম্বার।
প্রশাসনিক জীবনের শুরুতেই বলা যায় সিএবি-র সচিব পদের মতো হটসিটে। মানসিক প্রস্তুতি কী নেওয়াই ছিল?
স্নেহাশিস : আমি এর আগেও একবার সিএবি-তে পদে এসেছিলাম। সেটা ২০০৭-০৮ মরসুমে, সেবার আমি সহসচিব হয়েছিলাম। ওই পদে আমি দেড়বছর কাজও করেছিলাম। তাই একটা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।
আমি এটিকে কখনই হটসিট বলব না, সিএবি সচিব পদ একটা দারুণ সম্মানের জায়গা। যে ক্রিকেটার একটা সময় বাংলার হয়ে ১০-১১ বছর টানা ক্রিকেট খেলেছে, সেই মানুষটি যখন এমন একটা পদে কাজ করার সুযোগ পায়, সেটি অবশ্যই একটা সম্মানের বিষয়। আমি এইভাবেই দেখছি।
আমাদের এই টিমটা দারুণ। একজন তরুণ সভাপতি (অভিষেক ডালমিয়া) রয়েছে আমাদের। খুবই উদ্যোগী তিনি। সহসচিবও (দেবব্রত দাস) খুব কার্যকরি, ভাইস প্রেসিডেন্ট নরেশ ওঝা প্রাক্তন ক্রিকেটার। এমনকি কোষাধ্যক্ষ দেবাশিস গাঙ্গুলিও রয়েছেন এই টিমে।
ক্রিকেট প্রশাসনে আপনার আদর্শ বা আইডল কে? কাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
স্নেহাশিস : দেখুন, সেই ভাবে কাউকে আইডল বা আদর্শ ধরে এগোয়নি। কিন্তু সৌরভের শেষ চার-পাঁচবছরের কাজকর্ম এবং ওঁর চিন্তাভাবনা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি, ভাল লেগেছে ওঁর কাজ। এটুকু বলতে পারি।
প্রয়াত শ্রদ্ধেয় চন্ডী গাঙ্গুলি যখন সিএবি প্রশাসনে ছিলেন, সেইসময় আপনি ক্রিকেটার জীবনের মধ্যগগনে। বাবার প্রশাসক হিসেবে উত্তরণ আপনাদের দুই ভাই কী অনুপ্রাণিত করেছিল?
স্নেহাশিস : আমার বাবার কাছে ক্রিকেট ছিল শেষ কথা। ক্রিকেট তাঁর কাছে ধ্যানজ্ঞান ছিল। তিনি সেই ভাবে নিজের ব্যবসার পাশাপাশি সময় বের করে ক্রিকেট প্রশাসনে এসেছিলেন। এটা আমাদের কাছে একটি দৃষ্টান্তকারী ব্যাপার ছিল। তাই আমিও যখন ব্যবসার কাজ শেষ করে তিন-চার ঘন্টা সময় বের করি, আমার কাছে কঠিন হয়। তারপরেও ভাবি, বাবা যদি পারেন, তো আমি কেন পারব না? সেদিক থেকে প্রশাসনিক ভিত্তিটা বাবাই তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের দুই ভাইকে। আমিও সেই ভাবে সিএবি-তে আসার বিষয়ে আগ্রহ দেখাই। না হলে হয়তো আসতামই না।
বহুদিন আপনি ময়দানের বাইরে ছিলেন। নিজের ব্যবসা নিয়েই থেকেছেন। এখন কী একবারও মনে হচ্ছে না, প্রশাসনিক বিষয়ে দ্রুততা থাকলে এই চেয়ারের প্রাপ্তি আগে ঘটতো?
স্নেহাশিস : দেখুন, আমি মনে করি সব বিষয়েরই একটা সময় রয়েছে। আপনি চাইলেই সেটি আগে হয়ে যাবে, এমন কোনও ব্যাপার নয়। হয়তো আমার সেই সময়টা আসেনি, কিংবা সেই ম্যাচিউরিটি আসেনি, তাই আমার ধারণা, ঠিক সময়তেই আমার এই দায়িত্বটা এসেছে।
আপনার ভাই যখন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট, সেই পরিস্থিতিতে এই চেয়ারে বসে কাজটি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হয়?
স্নেহাশিস : জীবনে সব কাজই চ্যালেঞ্জিং। জীবনে যাই করতে যাবেন, তাতেই চ্যালেঞ্জের ছোঁয়া। যখন পড়াশুনো করতাম সেখানেও চ্যালেঞ্জ ছিল ভাল নম্বর পাওয়ার। যখন ক্রিকেটে এলাম, কিংবা বাংলার হয়ে খেলতাম, সেখানেও লড়াই ছিল।
আমি বাংলার হয়ে তিনবার রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল খেলেছি, ১৯৮৯, ৯০ এবং ১৯৯৩ সালে। সেদিক থেকে বলা যায় সেই দলে টিকে থাকাটাও চ্যালেঞ্জ ছিল। আর জীবনে যদি চ্যালেঞ্জ বা লড়াই না থাকে, তা হলে সেই জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়, নতুন আনন্দ থাকে না। না হলে ভাবুন না যাঁরা অবসর নিয়ে নিচ্ছেন, তাদের কাছেও অবসরজীবন সমান চ্যালেঞ্জের। কাজের মধ্যে থাকা, আর বাড়িতে বসে অফুরন্ত বিশ্রাম, কিভাবে সময়কে অতিবাহিত করবেন, সেটিও সমান একটা লড়াই। তাই আমি এইভাবেই জীবনকে দেখি।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ক্রিকেট মহল ভাইকে এগিয়ে দিতেই আপনি ইচ্ছে করে দৌড়টা সবদিক থেকেই পরে শুরু করেছেন?
স্নেহাশিস : আমি জানি না আপনি কোন দৌড়ের কথা বলছেন। কিন্তু আমি সৌরভের থেকে ক্রিকেট আগে শুরু করেছিলাম। এমনকি প্রথম প্রশাসনেও এসেছিলাম, সেটি আগেই বলেছি ২০০৭-০৮ সালে। তারপর হয়তো সরে গিয়েছিলাম ক্রিকেট থেকে। এবার ফিরে এলাম নতুন ভাবে।
আর সৌরভের কথা বলছেন। আমি বাংলার বাকি প্রাক্তন ক্রিকেটারদের সম্মান ও শ্রদ্ধা দিয়েই বলছি সৌরভ গাঙ্গুলির মতো প্রতিভা বহু রাজ্যের মতো আমাদের এখানেও আসেনি। পরবর্তীকালে যদি আসে, তা হলে আমি খুশি হবো।
১৯৮৯-৯০ মরসুমে রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল ম্যাচটিতে স্নেহাশিস গাঙ্গুলির সেই ঐতিহাসিক ত্যাগ না থাকলে ভারতীয় ক্রিকেটে সৌরভ নাম এক বিরল প্রতিভার জন্মই হতো না। সত্যিই কী সেদিন আপনি একলব্যর ভূমিকা পালন করেছিলেন?
স্নেহাশিস : একদমই নয়, কোনও ত্যাগের ব্যাপারই ছিল না, এটা ভুল কথা। সৌরভ বরাবরই ট্যালেন্টেড ক্রিকেটার। ওর বয়সও কম ছিল, ১৭ বছর হবে হয়তো। ফাইনালের আগে টিমের কম্বিনেশন দাবি করছিল যে মিডলঅর্ডারে একজন অলরাউন্ডার দরকার। সেই কারণেই মহারাজ দলে এসেছিল। ওটা টিমের চাহিদা ছিল। আমাকে সেই কারণেই সরতে হয়। সৌরভের সেই ম্যাচটাই কিন্তু বাংলার হয়ে অভিষেক ম্যাচ ছিল।
বাংলা ক্রিকেটে একটা প্রচলিত কথা রয়েছে, সেটি হল, সৌরভের থেকে অনেকবেশি প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন দাদা স্নেহাশিস। সত্যিই কী সেটা?
স্নেহাশিস : আমি তা মনে করি না। কারণ সৌরভ সবদিক থেকেই সুপার ট্যালেন্টেড ক্রিকেটার ও গ্রেট ফাইটার। ওঁর সঙ্গে কারোরই তুলনা চলে না। সে আমি কেন, বাংলার বাকি সকল সব ক্রিকেটারদের থেকে ও অনেকটা এগিয়ে। আর বাংলা থেকে অদূর ভবিষ্যতে যদি সৌরভের মতো এমন কোনও ট্যালেন্ট উঠে আসে, তা হলে আমার মতো সৌরভও হয়তো সবচেয়ে বেশি খুশি হবে!
দাদা হিসেবে আপনি কী সত্যিই মনে করেছিলেন, বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হিসেবে একদিন সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটবে?
স্নেহাশিস : এসব বিষয়গুলি পদ্ধতিগতভাবে হয়ে থাকে। আমার যতদূর মনে পড়ছে, সৌরভ যখন সিএবি-তে এলো ২০১৪ সালে সচিব হিসেবে। মাত্র একবছরের মধ্যেই ও দুম করে সিএবি সভাপতি হয়ে গিয়েছিল ২০১৫ সালে। কারণ সেইসময় আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় জগমোহন ডালমিয়া মারা গিয়েছিলেন। সেইসময় সৌরভ সভাপতি, আর অভিষেক হয় সচিব। আমার মনে হয় সিদ্ধান্তটি ঠিক ছিল। সবথেকে বড় কথা, সৌরভ সকলকে নিয়ে চলতে পারে। এটা ওঁর বিশেষ গুণ বলতে পারেন। আর দ্রুত কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।