কলকাতা : আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস ঘিরে নানা আলোচনা। মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে যেমন কথা হচ্ছে, তেমনি সমাজের বুকে মেয়েদের সমবন্টন নিয়েও বহু তর্ক চলছে। রাজনীতির অঙ্গনেও মহিলা ক্রীড়াবিদদের দাপট মনে করায় তাঁর তেজস্বিনী রূপকে।
তবুও আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসের প্রেক্ষাপটে জিমনাস্টিক্স, সাঁতার, টেবল টেনিস, কিংবা অন্যান্য খেলাধুলোয় কী সুরক্ষিত মেয়েরা? কিন্তু খেলাধুলোর অঙ্গনে অভিভাবকরা নিশ্চিন্তে মেয়ে সন্তানদের দিয়ে গিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন কী?
এই নিয়ে ঠিক কী পরামর্শ দিচ্ছেন নামী প্রাক্তন মহিলা ক্রীড়াবিদরা, খেল আপডেটসের প্রতিবেদন।
ঝুলন গোস্বামী (ক্রিকেটার) : আমি বলব কয়েকটি কথা। যেগুলি সমাজের আসল সমস্যা। আমরা সহজে মানুষদের বিশ্বাস করে যাই। এটা কোনও শিক্ষক কিংবা কোচ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। আগে পরিস্থিতি দেখে নিতে হবে কোনটি আমাদের অনুকূলে রয়েছে। অভিভাবকদের সতর্কতা ছাড়া সন্তান একেবারেই অসহায়। তবুও এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি ভোকাল, এটা উচিত।
সমাজ বদলেছে, দৃষ্টিভঙ্গী বদলেছে। সবসময় সন্তানদের পাঠানো উচিত দলবদ্ধভাবে। একা শেখার দিন শেষ, তা কন্যা সন্তানদের জন্য তো বটেই। খেলাধুলোর ক্ষেত্রে তো আরই। এমনকি কন্যা সন্তানদের স্বাধীনতা দিতে হবে, তারা কী বলতে চায়, সেটি বুঝতে হবে অভিভাবকদের। তাদের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বুলা চৌধুরী (সাঁতারু) : এইগুলি নিয়ে সমস্বরে প্রতিবাদ হওয়া উচিত। সবাই যাতে অসভ্যতা করার আগে ভয় পায়। আমি তো ওই নিপীড়িত মেয়েটিকে সাধুবাদ জানাব। সে যেভাবে সাঁতারের ওই কোচের মুখোশ খুলে দিয়েছে, তারপর থেকে সবাই বুঝে গিয়েছে চুপ করে থেকে বরং নিজেরই ক্ষতি।
আমি অভিভাবকদের পরামর্শ দেব তারা যে কোনও স্তরে সন্তানদের পাঠানোর আগে সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হোন। নিজেরা গিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করুণ, কার কাছে মেয়েকে পাঠাচ্ছেন, সেই নিয়েও চেতনা থাকা জরুরী।
শান্তি মল্লিক (ফুটবলার) : এমনকিছু খেলা রয়েছে যেখানে মেয়েদের শরীর স্পর্শ করতেই হয়, সেই সব খেলায় পাঠানোর আগে অভিভাবকদের সতর্কতা জরুরী। ফুটবলেও এমন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু অনেকেই চক্ষু-লজ্জার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না। আমি তো বলব, স্কুলে এখন টিচারদেরও উচিত শেখানো কিভাবে এর মোকাবিলা করা যায়।
সোমা বিশ্বাস (অ্যাথলেটিক্স) : আমি তিনটি কথা বলতে চাই। এক, অভিভাবকদের সতর্কতা দরকার। বিশেষ করে কন্যা সন্তানের মায়ের। দ্বিতীয়ত, যেখানেই পাঠানো হোক না কেন, সব অবস্থা বুঝেই সেখানে পাঠানো উচিত। সে পঠনপাঠন বলুন বা খেলার শিক্ষা। তৃতীয়ত, যে কোনও জায়গায় টিচারদের কাছে গেলে কোচিং বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাতে দুটি বিষয় হয়, এক সন্তান বুঝতে পারে বাকিদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য, আর নিরাপত্তাও সুরক্ষিত থাকে।
এমনকি আমি বলব, যে কোনও উঠতি মহিলা শিক্ষার্থিদের ক্ষেত্রে বাইরে বা কোনও ট্যুরে গেলে বাবা-মাকেও তাদের সঙ্গে যাওয়া উচিত। একা কোনও অবস্থাতেই সন্তানদের পাঠানো উচিত হবে না।
পৌলমী ঘটক (টেবল টেনিস) : এই ধরনের সমস্যা মানবিক বিকার ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। মানুষ হতাশা থেকে এগুলি করে থাকে। উগ্রতাও এর কারণ হতে পারে। আগেও ছিল না, এমন বলা যাবে না, কিন্তু এখন ছেলেমেয়েরা অনেকবেশি সাহসী, তারা প্রতিবাদ করতে জানে। এটাই সমাজের পক্ষে শুভ লক্ষ্মণ। তবে অভিভাবকদের সন্তানদের সাহস দিতে হবে, তারা যাতে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে।
স্কুলেও কন্যা সন্তানদের শেখানো উচিত তাদের নানাবিধ স্পর্শ সম্পর্কে। আমাদের কোনওদিন এই সমস্যায় পড়তে হয়নি। কারণ আমরা ভাগ্য করে স্যারদের পেয়েছিলাম, তারা আমাদের পিতৃস্নেহে শিখিয়েছেন।
স্বপ্না বর্মণ (অ্যাথলেটিক্স) : আমি কোনওদিনই এমন সমস্যায় পড়িনি, বা চিন্তাও করিনি। তবে এটা একটি সামাজিক রোগ, যাকে আমরা পুরোটা কবে নির্মূল করতে পারব, জানি না। আমাদের পরিবারের সন্তানদের চেতনা ফেরাতে ও তাদের সজাগ করতে পারে তাদের অভিভাবকরা। তাই আমি অভিভাবকদের বলব তারা যেন সহজে কাউকে বিশ্বাস করে সন্তানদের দেখভাল কারোর ওপর ছেড়ে না দেন। নিজেরা আগে ভাল করে জানুন, তারপর যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিন।
জয়দীপ কর্মকার (শুটিং কোচ ) : আমার অন্যতম ছাত্রী হল মেহুলি ঘোষ, এছাড়াও আমার কাছে ১০ থেকে ২২ বছরের মেয়েরাও শুটিং শেখে, তাই আমি তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে কাজ করতে ভালবাসি। তারা যাতে আমাকে বিশ্বাস করতে পারে, বা সম্মানের জায়গাটা ঠিক থাকে, তেমনি আচরণ করি। আগে শিক্ষার্থিদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা কেমন, সেটি জানতে হবে, তারপর তারপর তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে ওই শিক্ষার্থির মানসিক বিষয়। সে কী পছন্দ করে, কোনটি নয়, সেটি একজন কোচ হিসেবে সকলের জানা প্রয়োজন।
সুভাষ সরকার (অ্যাথলিট কোচ ) : আমার কোচিং নিচ্ছে স্বপ্না একেবারে শুরু থেকেই বলতে পারি, তাও সেইসময় স্বপ্নার বয়স ১৩ বছর হবে। তারপর থেকে টানা আমার কাছেই শিখছে। এর আগেও আমার কোচিংয়ে বহু মহিলা অ্যাথলিটরা রাজ্য ও জাতীয় সেরা হয়েছে।
আমি মনে করি, যৌন হেনস্থা বা নিপীড়ন এটি এক ধরনের রোগ, এরজন্য আমাদের সতর্কতার দরকার রয়েছে। আমাদের এই নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। আমি কোনওদিন মহিলা অ্যাথলিটদের স্পর্শ করে শেখাতে যাই না। এটি আমি বরাবর করে এসেছে, যেগুলি হাতেকলমে দেখাতে হবে, সেটি নিজের কায়দায় শিখিয়ে দিই।
জয়প্রকাশ চক্রবর্তী (জিমনাস্টিক্স কোচ ) : সবসময় মনে রাখবেন মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুবই সজাগ। তারা জানে তাদের কীভাবে ব্যবহার করছে, কিংবা তাদের প্রতি অন্যদের মনোভাব। তাই সব কোচদেরই মনে রাখতে হবে তারা যাতে এমন কোনও ব্যবহার মহিলা শিক্ষার্থিদের সঙ্গে না করে যাতে তাদের সম্মানহানি হয়।
আমার হাত ধরে বহু সফল জিমনাস্ট উঠে এসেছে। টুম্পা দেবনাথ থেকে শুরু করে প্রণতি দাস, রূপালি হালদার, প্রতিষ্ঠা সামন্ত, বিদিশা গায়েন, এমনকি আমার নতুন ছাত্রী অনুষ্কা জানাও ভাল করছে, তাই আমি সবসময় তাদের সঙ্গে পিতৃস্নেহে ব্যবহার করে থাকি। জিমনাস্টিক্সে শরীর স্পর্শের দরকার পড়লেও এখন অ্যাসিসটেন্ট একজন মহিলাও রাখি, সেই তাদের দেখিয়ে দেয়।
কোচেদের পাশে যাঁরা অভিভাবক, তাঁদেরই বা এই বিষয়ে কী মনোভাব পোষন করেন, তারও ঝলক এই লেখায়… এরকমই একজন সফল জিমনাস্ট ও টেবল টেনিস তারকার অভিভাবকের সঙ্গে কথাও বলা হয়েছে।
অলোক জানা (জিমনাস্ট অনুষ্কার বাবা) : আমার মেয়ে অনুষ্কা যেমন সাই কলকাতা সেন্টারে আবাসিক হোস্টেলে থেকে জিমনাস্টিক্স শিখছে স্যারেদের কাছে। সাই-য়ে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা কম থাকে, তারচেয়েও বড় কথা, ওরা হোস্টেলে বাকি জিমনাস্টদের সঙ্গে থাকে, যেখানেই যায়, ওরা একই সঙ্গে যায়। তাই পৃথক শেখার কোনও ব্যবস্থা নেই। তবুও মেয়ে দূরে থাকে বলে একটা চিন্তা তো থেকেই যায়।
জয়ন্ত বড়ুয়া (টেবিল টেনিস প্লেয়ার সায়নীর দাদামশাই) : আমার নাতনিকে আমরা টেবল টেনিস শিখতে নিয়ে যাই হিন্দমোটরে। সঙ্গে আমার স্ত্রী-ও থাকেন। গাড়ি করে যাই ও আসি। কাছেপিঠে কোথাও দিতে পারতাম, কিন্তু আমাদের কাছে ভাল শেখাটাই বেশি অগ্রাধিকার। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন ভাবনা নেই, সায়নীদের স্কুলেও এই বিষয়ে বেশ কড়া।