কলকাতা: আই লিগে ইতিহাস সৃষ্টি করল মোহনবাগান। তারা ১৬ ম্যাচ খেলেই, চার ম্যাচ বাকি থাকতেই খেতাব পেয়ে গিয়েছে মঙ্গলবারেই আইজলকে হারিয়ে।
এই আইজলের কাছে ২০১৭-১৮ মরসুমে হেরে খেতাব হারায় তারা। কিন্তু সেই হারের মধুর প্রতিশোধ নিয়ে সবুজ মেরুন দল বোঝালো তারা যোগ্য দল হিসেবেই এবার চ্যাম্পিয়ন।
মোহনবাগানের এই দলের কান্ডারী অবশ্যই কোচ কিবু ভিকুনা। দলকে একটা ইউনিট হিসেবে তৈরি করেছেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গড়ে তুলে তিনি বুঝিয়েছেন সফল কোচ হতে গেলে গাম্ভীর্য হওয়ার দরকার পড়ে না। বরং দলের ফুটবলারদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে তিনি হয়ে উঠেছেন দলের প্রকৃত হেডস্যার।
টানা ১৪ ম্যাচ অপরাজেয় থেকে মোহনবাগান ১৬ ম্যাচে ৩৯ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল। এই ভাবে মসৃণভাবে খেতাবের কী রহস্য, কী করে দলের মধ্যে একটা চ্যাম্পিয়ন মনোভাব গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, সেই নিয়ে মোহনবাগানের প্রাক্তনদের কথায় উঠে এল নানা প্রসঙ্গ।
সুব্রত ভট্টাচার্য্য : মোহনবাগানের এই দলটি সবদিক থেকে আলাদা। শেষবার সঞ্জয় সেনের কোচিংয়ে যে দল খেতাব পেয়েছিল, সেই দলের থেকেও সেরা। কারণ দুটি, এক কোচ ভিকুনা অসম্ভব ভাল ট্যাক্সটিসিয়ান, তিনি নিজের দল নিয়ে যেমন পড়াশুনো করেন, তেমনি প্রতিপক্ষ দল নিয়েও দারুণ হোমওয়ার্ক সারেন। এমন কোচ ভারতে দেখা যায় না। তিনি প্রকৃতঅর্থের একজন গুণী কোচ।
যদিও আমি বলব তিনি দলে বেশকিছু ভাল মানের তারকা পেয়েছেন। বেইতিয়া, ফ্রান মোরান্তে, ফ্রান গঞ্জালেজ, কিংবা বাবা দিওয়ারা সবাই ভাল। দলের রিজার্ভ বেঞ্চটাকে দারুন তৈরি করেছেন। আমার মতে, মোহনবাগানের এই দলটি শেষ সাতবছরের মধ্যে সেরা।
সত্যজিৎ চ্যাটার্জি : মোহনবাগান এই দলটির ‘ইউএসপি’ হল টিম গেম। এমন খেলা আমি অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেমের পরে আবারও দেখলাম। আমি এই দলের সঙ্গে যেহেতু সরাসরি যুক্ত, ক্লাবের অন্যতম কর্তা, সেই কারণে আমি প্রতিদিন প্র্যাকটিসে এসে লক্ষ্য করেছি কিভাবে এই দলটিকে নিবিড়ভাবে তৈরি করেছেন কোচ ভিকুনা। তাঁর কোচিংয়ের সবথেকে বড় বিশেষত্ব হল, তিনি দলের গেমপ্ল্যান তৈরি করেন তিনটি। একটি ছক না খাটলে বাকি দুটি কী করা উচিত ভেবে রাখেন, সেই মতো দলের ফুটবলারদের বোঝাতে পেরেছেন।
আমি অমল দত্তের ক্ষেত্রে দেখেছি তিনি একজন ফুটবলারকে ছাড়তেন না যতক্ষণ না তিনি বুঝছেন, ভিকুনাও তাই। তিনি ঘন্টার পর ঘন্ট সময় দেন একজন ফুটবলারকে বোঝাতে। সেই কারণে ভিপি সুহের, শেখ শাহিল, শুভ ঘোষদের ভারতীয়দেরও তিনি তৈরি করতে পেরেছেন যোগ্যভাবে।
কম্পটন দত্ত : সাবাশ মোহনবাগান। সাবাশ টিম ভিকুনা। আমি এমন কোচ ভারতীয় ফুটবলে সাম্প্রতিককালে দেখেনি। আমি মনে করি এই কোচকে যদি ভারতীয় দলের কোচ করে দেওয়া হয়, তা হলে সেই দলকে নিয়েও ফুল ফোটাবেন তিনি। ভিকুনা এমন ধাঁচের মানুষ, যিনি কী সাধারণ থেকে নিজের সেরাটা দিতে পারেন। তাঁর বিশেষত্ব হল, তিনি দলের ফুটবলারদের কোনও দোষ দেন না, তিনি বরং দলের ফুটবলারদের ব্যর্থতায় তাঁদের পাশে থাকেন। আমি এমন মানুষও দেখেনি, বিশেষ করে কোনও কোচকে। তিনি দলের ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে নেন। ডুরান্ড হারের পরে সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।
ভিকুনার মতো কোচকে আমাদের দরকার। যিনি নিজের দেশ স্পেনের ফুটবল ঘরানা আমাদের মতো দেশে আমদানি করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। সেই কারণেই মোহনবাগান দল এবার ২৪ পাসে একটি গোল করেছে। দারুণ টিমগেম না থাকলে এমন হয় না।
মানস ভট্টচার্য্য : আমার বেশ মনে পড়ছে চলতি আই লিগেই চার্চিলের কাছে হারের পরে আমি কোচ ভিকুনার সমালোচনা করেছিলাম। তখন বুঝিনি ওই স্প্যানিশ কোচের কোচিং জাদু। টুর্নামেন্ট যত গড়িয়েছে ততই তিনি ফুল ফুটিয়েছেন। এমন একটি দলকে গড়ে তুলেছেন যাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়, আমি তো বলব এই ভিকুনার মধ্যে আমি যেমন দেখেছি পি কে ব্যানার্জিকে, তেমনি অমল দত্তকেও।
প্রদীপদা-র মতো তিনি ধুরন্ধর ট্যাকটিক্স করেন। দলের ফুটবলারদের দারুণ মনস্তত্ত্ব বোঝেন। তিনি যেভাবে বেইতিয়া, মোরান্তে, গঞ্জালেজ, দিওয়ারাদের প্রস্তুত করেছেন, আমি বলব তিনি যেহেতু স্প্যানিশ। সেই জন্যই স্প্যানিশ ফুটবলারদের নিয়ে ঘুঁটি সাজাতে পেরেছেন। দিওয়ারা যদিও সেনেগালের, কিন্তু ভাল স্প্যানিশ জানে।
তারপরেও ভিকুনার কোচিংয়ে উঠে এসেছে শাহিল, শুভরাও। আর অমল দত্তের মতো নিবিড়ভাবে থেকে দলের কৌশল সারতে পারেন। তিনি পাসিং ফুটবল ফিরিয়ে এনেছেন দলে। একটা দলের টিমগেম ভাল না হলে পাসিং ফুটবল খেলা যায় না। তিনি গোল করার দায়িত্ব দিয়েছেন দলের মিডফিল্ডারদেরও। সেই জন্য পজিটিভ স্ট্রাইকার ছাড়াও মোহনবাগানের বাকিরাও গোল করে ম্যাচ জিতিয়েছে।