কলকাতা: একটা আক্ষেপ কাজ করছিল কিবু ভিকুনার। গত বৃহস্পতিবারই বলেছিলেন, একদিন এর মধ্যেই সময় করে হাসপাতালে দেখতে যাবেন অসুস্থ পি কে ব্যানার্জিকে।
২০ মার্চ, শুক্রবারই যে কিংবদন্তি কোচের জীবনদীপ নিভে যাবে, কল্পনাই করতে পারেননি মোহনবাগানের স্প্যানিশ কোচ। কিবুকে ফোনে ধরা হল, একরাশ হতাশা ভরা গলায় বলছিলেন, ‘‘ওহ! সত্যিই আমার কাছে এটা দারুণ হতাশার বিষয়। আপনি আমাকে আগেরদিনই পিকে নিয়ে বলেছিলেন। আমারও ইচ্ছে ছিল ওঁকে দেখতে যাওয়ার। সেই সুযোগটাই দিলেন না ঈশ্বর। একটাই প্রার্থনা করতে চাই, উনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন।’’
সাক্ষাৎকারে অনেক কথাই উঠে এসেছিল, তবে তার মধ্যে দেখা দিয়েছিল সদ্য প্রয়াত পিকে-র কথাও। তাঁর সঙ্গে পরিচয় নেই, কেউ আলাদাভাবে বলেওনি তাঁর কথা। কিন্তু কিবু এতটাই মানবিক যে ভারতীয় ফুটবলের একজন পুরোধা হাসপাতালে শয্যাশায়ী, তিনি খোঁজ রেখেছিলেন।
হলো না শেষ দেখা…
আমার পরিষ্কার ঠিক মনে পড়ছে না, হয়তো গোকুলাম ম্যাচের আগে ক্লাব প্র্যাকটিসের সময় একদিন আচমকা একটা ঘটনা ঘটল। তাঁরা আমাকে ভরসা করতে শুরু করেছেন।
একদিন এক প্রবীন সমর্থক আমাকে জড়িয়ে ধরে জানালেন, জানেন তো কোচ, আপনার কোচিং টেকনিক আমাদের অমল দত্তের মতো।
ওইদিন প্রথম আমি অমল দত্ত নামটি শুনেছিলাম। প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। এসে ক্লাবের এক অফিসিয়ালকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা অমল দত্ত কে? উনি আমাকে বললেন ভারতীয় ফুটবলের এক বড় কোচ।
তারপরেই ওই কর্তা আমাকে প্রদীপ ব্যানার্জির কথা বলেছিলেন। এও গল্প করেছিলেন ১৯৯৭ সালের একটা ম্যাচে (ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনাল), ১৩ জুলাই, ১৯৯৭) দুই কোচের লড়াই দেখতে প্রায় দেড় লক্ষ (১লাখ ৩১ হাজার) মানুষের জমায়েত হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম সেই ঘটনা।
ভারতের মতো একটা দেশ, যারা ফিফা ক্রম তালিকায় কত পিছনে রয়েছে, তাদের দুটি ক্লাবের খেলা দেখতে এত লোক মাঠে আসতে পারে? তারপর আমি যখন মোহনবাগানের কোচ হিসেবে প্রথম ডার্বিতে কোচিং করলাম, সেদিন বুঝেছিলাম কেন প্রাক্তন ফিফা সভাপতি (শেপ ব্লাটার) ভারতকে ফুটবলের ‘ঘুমন্ত দৈত্য’ বলেছিলেন।
সেদিন আরও একবার ভারতের দুই নামী প্রাক্তন কোচের (পিকে ও অমল) বিষয়ে শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। সেই পি কে ব্যানার্জির বিষয়ে তারপরেও অনেক শুনেছি। উনি ফিফার ‘অর্ডার অব মেরিট’ সম্মান পেয়েছিলেন। তাতেই বোঝা যায় ওঁর ব্যাপ্তি। শেষ দেখা হলে ভাল লাগত। কিন্তু ঈশ্বরই মনে হয় সেই সুযোগটা আমাকে দিলেন না।
এশিয়াতেই কোচিংয়ের স্বপ্ন ছিল
ভারতে কোচিং করাতে না এলে হয়ত জাপানে, সিঙ্গাপুর, কাতার কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় যেতাম। আমি অনেকদিন ধরেই পোল্যান্ড ছেড়ে বেরতে চাইছিলাম। কারণ একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আমি একটা নতুন ছক নিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টায় ছিলাম। পোল্যান্ডের ক্লাবে গিয়ে করতে গেলে নানা সমস্যা হতো। তারা খুব একটা কোচদের স্বাধীনতা দিতে চায় না। আমি ভেবেছিলাম এশিয়ার কোনও দলে গিয়ে আমার সেই পরিকল্পনাকে কার্যকর করব।
ভারতে এসে অবশ্য ভুলটা ভাঙল। তারপর এমন একটা দলের কোচিং করাতে এলাম। যে দলের বহু সমর্থক সারা বিশ্বেই প্রায় ছড়িয়ে রয়েছে। এখানেও কোচদের ওপর ভীষণ চাপ থাকে। আমি এতটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু লিগ, ডুরান্ডে হারতে আমি চাপটা অনুভব করেছিলাম।
আমাকে এখানকার অফিসিয়ালরা স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন এখানে সমর্থকরা জয় ছাড়া কিছু জানে না। কিন্তু আপনি নিজের মতো করে দলটিকে দাঁড় করান। আমি সেই চেষ্টাই করেছি। খেয়াল করে দেখবেন, আমি দলটিকে শুরুতে সেট করতে পারিনি। কারণ আমার হাতে ১৬ জনের ভাল দলও ছিল না। স্থানীয়দের নিয়ে চেষ্টা করেছি, তারপর ধীরে ধীরে স্প্যানিশ ছেলেরা ভাল খেলতে দলটিও ছন্দে ফেরে।
ভারতীয় ফুটবল ও বিদেশী কোচ
ভারতীয় ফুটবল নিয়ে ফেডারেশন ভাল কাজ করছে। তারা জুনিয়র স্তরে ভাল নজর দিয়েছে। ইসাক দরুর মতো কোচকে অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর করেছে। জাতীয় দলের কোচ করেছে ইগর স্টিম্যাশকে। তার মানে ফেডারেশন ভারতীয় দলটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। পরিকাঠামোর দিকে নজর দিয়েছে।
ভারতে প্রতিভা রয়েছে, কিন্ত তাদের মনের জোরটা বাড়াতে হবে। আমিও মোহনবাগানে এসে সেই কাজটাই করেছি। ওদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছি। কিন্তু এও বলেছি, বিপক্ষকে সমীহ করবে। যে কোনও দলই ভয়ঙ্কর হতে পারে নিজেদের দিনে। তাই বাড়তি আত্মতুষ্টি যাতে না আসে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
আমি ভারতীয় দলের খেলা দেখেছি। তাদের মধ্যে একটা জোর এসেছে। সেটি ইগরই এনে দিয়েছেন। প্রতিপক্ষ দলকে সমীহ করো, কিন্তু মাথায় তুলো না, সেটাই আমার রসায়ন। আমার মনে হয় ক্রোয়েশিয়া কোচ ইগরেরও তাই ভাবনা। তবে ভারতীয় ফুটবলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে ফেডারেশনকে আরও ভাল ভাল অ্যাকাডেমি করতে হবে। সেখানে প্রতিভাবান ফুটবলারদের বাছাই করে আধুনিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আচমকা বাড়ি থেকে ফুটবলার আসবে না। প্রতিভা থাকলেই হবে না, সেটিকে স্পেনের মতো ঘষামাজা করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
পড়েছি সাংবাদিকতা, হলাম কোচ
আমি একসময় জার্নালিজম নিয়েও পড়েছি, ডিগ্রিও রয়েছে। এমনকি বছর দুয়েক স্পেনে একটা পেপারে কাজও করেছিলাম। ভেবেছিলাম ফুটবলে না এলে হয়তো সাংবাদিক হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু হলো না।
আমার বয়স যখন ১৬, আমার শিক্ষক পেড্রো মার্টাস আমাকে একদিন বললেন, তুমি এল রেডিন স্কুলের জুনিয়র দলকে কোচিং করাও। সেই শুরু, তারপর ইউনিভার্সিটি অব নাভারা দলেরও জুনিয়রদের কোচিং করিয়েছি।
সেই দলের মূল কোচ একদিন এলেন না, আমি একটা ম্যাচে দলকে কোচিং করিয়ে সেই দলকে জিতিয়েছিলাম। তবে আমি পোল্যান্ড ও স্পেনে যে কয়েকটি ক্লাবে কোচিং করিয়েছি, সেখানে সহকারী হিসেবেই কাজ করেছিলাম। মোহনবাগানে এসে মূল কোচের দায়িত্ব সামলাই।
আমি কোচ হিসেবে পছন্দ করে এসেছি পেপ গুয়ার্দিয়লাকে। ওঁর আত্মজীবনী ‘অ্যানাদার ওয়ে অব উইনিং’ – আমি বহুবার পড়েছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। তাঁর পাসিং তিকিটাকা ফুটবলের প্রতি আমিও সমান অনুরক্ত ছিলাম। সেটিকেই মোহনবাগানে এসে এই কয়েকমাসে চেষ্টা করে ফলপ্রুসু করেছি। ২৩ পাসের গোল সেই থেকেই এসেছে।