কলকাতা: সোমবার থেকে বাংলা দল রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খেলতে নামছে। তার আগে বঙ্গ পেস ত্রয়ীর একনম্বর বোলার ২২ বছরের ঈশান পোড়েলকে ঘিরে আশার স্রোত। মনে করা হচ্ছে, ঈশান যদি ছন্দে থাকেন, তা হলে বিপক্ষের চেতেশ্বর পূজারা, শেলডন জ্যাকসনরা খুব একটা ভাল অবস্থায় থাকবেন না। ঈশানের বলের গতিবেগ প্রায় ১৪০ কিমি।
‘বাংলার ম্যাকগ্রথ’। ‘চন্দননগর এক্সপ্রেস’। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা। বোলিং স্টাইলের মধ্যে দুইজনের ছায়া, ব্রেট লি এবং ডেইল স্টেইন।
কর্ণাটক ম্যাচে যেভাবে তিনি লোকেশ রাহুলকে আউট করেছেন, সেই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের একটা অংশ মনে করছেন বিট্টু (ঈশানের ডাকনাম) লম্বারেসের ঘোড়া। তিনিই অনুর্ধ্ব ১৯ দলের সেই বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি, যিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালে চার উইকেট ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুই উইকেট নিয়ে সাড়া জাগিয়েছিলেন।
সময়ের সঙ্গে সেই ঈশান আরও অভিজ্ঞ। চন্দননগরের আশুতোষ নিয়োগী লেনের বাসিন্দাই এখন বাংলা দলের পয়লা নম্বর পেসার। দিনবদলের সঙ্গে তাঁর উইকেট নেওয়ার পরে উচ্ছ্বাসের রংয়েরও বদল ঘটছে। ঈশানের বোলিংয়ের সঙ্গে তাঁর স্টাইল স্টেটমেন্ট নিয়েও সমান কথা হচ্ছে।
রাজকোটে যাওয়ার দুইদিন আগে চন্দননগরের বাড়িতে খেলআপডেটস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উঠে এল তাঁর অজানা কাহিনী। যা ফাইনালের আগে বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের চনমনে রাখবে।
আপনাকে নিয়ে বাংলার কোচ অরুণলাল প্রবল আশাবাদী, তিনি জানিয়েছেন ঈশান যা ফর্মে রয়েছে, ওর বোলিং খেলতে সমস্যায় পড়বে খোদ বিরাট কোহলিও। আপনি এই কথা শুনে কতটা তেতে রয়েছেন?
ঈশান : দেখুন এটা একটা দলের কোচ বললে স্বাভাবিকভাবেই মনের জোর বেড়ে যায়। কথাটি যখন লাল স্যার বলেছেন, সেটি শুনে ভাল লেগেছে, আবার মনে হচ্ছে দায়িত্বও বেড়ে গেল।
আমি যখন মাঠে নেমে বোলিং করি, সেইসময় ভাবি না আমার সামনে কাকে বোলিং করছি। লক্ষ্য থাকে নিজের সেরা বোলিং করার। সব অস্ত্র সবসময় বের করি না, ব্যাটসম্যান অনুযায়ী সেটিকে প্রয়োগ করে থাকি। হ্যাঁ, অবশ্যই এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি। তাঁকে ঘরোয়া ক্রিকেটে কিংবা আইপিএলের আসরে আউট করতে পারলে ভাল তো লাগবেই। তবে আবারও বলছি, নিজের কাজটি করতে চাই সঠিকভাবে।
বাংলা দলের মূল শক্তি এবার পেস বোলিং লাইনআপ। বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে বাংলার তিন পেসার। এই সাফল্যের কারণ কী?
ঈশান: একটা কথা মনে রাখবেন আমাদের ভারতীয় দলের তিন পেসারও কিন্তু ছন্দে রয়েছে। সেখানেও বুমরা, সামি, ঈশান্ত শর্মারা নিজেদের মধ্যে দারুণ সমঝোতা গড়ে তুলেছে নিজেদের মধ্যে। আমার, আকাশদীপ ও মুকেশের মধ্যেও খুব ভাল বোঝাপড়া রয়েছে। আমরা জানি একে অপরের শক্তি ও দুর্বলতা। কেউ সাফল্য পেলে অন্যকেও আমরা সেই সাফল্যের ভাগীদার করে নিই। আবার কেউ ব্যর্থ হলে তাকে সাফল্যে ফেরানোর জন্য নানা পরামর্শ দিয়ে থাকি। এটাই এবারের বাংলা দলের মূল মন্ত্র, যে কোনও সমস্যায় একে অপরের পাশে থাকো।
আপনার বোলিংয়ের সেরা অস্ত্র কোনটি? এবার বাংলা দলের মধ্যে আগ্রাসণের কারণ কী? এবং সৌরাস্ট্র দলে চেতেশ্বর পুজারা রয়েছেন, তাঁকে কিভাবে ফেরাবেন?
ঈশান: সাদা বলে ইয়র্কার ও স্লোয়ার বাউন্সার। লাল বলে থ্রি কোয়ার্টার লেংথ ডেলিভারি। পূজারা এবার নিউজিল্যান্ডে ইনসুইংগারে কাহিল হয়েছে। আমিও সেই ভাবেই হোমওয়ার্ক সারব। আমি জানি ওঁকে ফেরানোর ওষুধ।
বাংলা দলের আগ্রাসনের কারণ হল, কোচ কাম মেন্টর অরুণ লালের উপস্থিতি। তিনি এসে দলের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বদলে দিয়েছেন। আমরা যেভাবে প্র্যাকটিসে থাকি, সেই ভাবেই ম্যাচে হাজির হই। আমাদের আরামের কোনও জায়গা নেই। নিজেদের নিংড়ে দিতে পছন্দ করি। বিপক্ষ সম্পর্কে আমাদের দারুণ একটা ভিডিও সেশন হয়, সেটাতেই জানতে পারি ওদের শক্তি ও দুর্বলতা। সেইভাবেই নিজেদের মেলে ধরি আমরা।
জেলা থেকে বাংলায় ক্রিকেটের জোয়ার আসছে। আপনি কী বলবেন?
ঈশান: এটা বাংলা ক্রিকেটের পক্ষেই ভাল সংকেত। এই দলে যেমন আমি, অর্ণব নন্দী, অনুষ্টুপ মজুমদার সবাই হুগলীর। বাকিরাও অনেকে জেলা থেকে উঠে এসেছে। সিএবি ভাল কাজ করছ জেলা স্তরে, এটা তারই ইঙ্গিত।
আমার কাছে অবশ্য এই জার্নিটা কঠিনই ছিল। এতদূর থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় যেতে হয়েছে। সারাদিন অসম্ভব খাটুনির পরে ফের রাতের ভিড় ট্রেনে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পরেই অবশ্য গাড়ি কিনেছিলাম, এখন সেটি করেই কলকাতায় যাতাযাত করি।
বাংলার হয়ে অভিষেক ম্যাচ কতটা স্মরণীয়? সেরা পারফরম্যান্স বলতে কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন এখনও পর্যন্ত?
ঈশান: গতবছরই বাংলা সিনিয়র দলের হয়ে কল্যাণীতে বিদর্ভের বিরুদ্ধে রঞ্জি ম্যাচে প্রথমদিনই আমি ৪৭ ওভার বোলিং করে চারটি উইকেট পেয়েছিলাম। এটা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেই ম্যাচে আমি ১৩৫কিমি গতিবেগে বোলিং করেছিলাম। ওই দলের দুইজন্য ব্যাটসম্যানকে মাথায় চোট পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ম্যাচটি আমরা জিতেছিলাম বড় ব্যবধানে।
সেরা পারফরম্যান্স অবশ্যই ২০১৮ সালে অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পাক দলের বিপক্ষে চার উইকেট। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও ফাইনালে দুই উইকেট পেয়েছিলাম। তারপরই সবাই আমার নাম জেনেছে। বুঝেছে ঈশান পোড়েল এসে গিয়েছে!
আইপিএলে বাংলা থেকে একমাত্র আপনিই কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে মাঠে নামবেন। যে দলের ক্যাপ্টেন কে এল রাহুল। ইডেনে কথা হলো ওঁর সঙ্গে?
ঈশান: কিছু কথা তো হয়েইছে। তবে আইপিএলে ভাল বোলিং করা আমার কাছে চ্যালেঞ্জের। কারণ আইপিএলে ডাক পাওয়াও বিশেষ ব্যাপার। আমার ওপর পাঞ্জাব ভরসা রেখেছে বলেই আমাকে নিয়েছে। এই আসরে বিদেশী তারকাদের আউট করতে পারলেও আমার অভিজ্ঞতা বাড়বে সন্দেহ নেই। লক্ষ্য থাকবে কোহিলকে ফেরানো, ওটা আমার স্বপ্নও বলতে পারেন।
সৌরাষ্ট্র দলে অনেকবেশি ভারসাম্য রয়েছে। কী মনে হয় খেতাব ৩০ বছর পরে বাংলায় আসবে?
ঈশান: সৌরাষ্ট্র ভাল দল সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের ওপেনারদের মতো ওদেরও শুরুর ব্যাটসম্যানরা ছন্দে নেই একেবারে। দলের মিডলঅর্ডার ধরছে ইনিংস, আমাদেরই মতো। দলে শেলডন জ্যাকসন রয়েছে, ওই ভয়ঙ্কর, চেতেশ্বর পূজারা ভুল করে না সাধারণত। ওকে ভুল করাতে হবে।
আর আমি ব্যক্তিগতভাবে চার নম্বর ফাইনাল ম্যাচ খেলতে নামছি। আগের তিনটি ফাইনালেই আমি জিতেছি। সেদিক থেকে আমার ফাইনাল জয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কারণ বাংলার হয়ে কোচবিহার ট্রফিতে অনুর্ধ্ব ১৯ সর্বভারতীয় টুর্নামেন্টে জিতেছিলাম। তারপর অনুর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দলের হয়ে নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপ সেরা। আর শেষটি অনুর্ধ্ব ২৩ বাংলা দলের হয়ে সি কে নাইডু ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন। তাই আমি এবারও ট্রফিই দেখছি।