কলকাতা: ১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। পেলের কসমস ক্লাব খেলতে এল। পিকে ব্যানার্জির দুই ভাবশিষ্য — সুধীর কর্মকার আর গৌতম সরকার বলছিলেন কসমসের বিপক্ষে তারা ২-২ ড্র করতে পেরেছিলেন প্রদীপদা-র কোচিংয়ের কারণে।
বেটেখাটো ডাকাবুকো ডিফেন্ডার সুধীরকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিলেন পিকে। রিষড়ার বাড়ি থেকে জানালেন, “সেদিন ম্যাচে পেলেকে আমি বেশ কয়েকবার ট্যাকল করেছিলাম। কিন্তু একবারও তাঁর পা সরাতে পারেনি। সেদিন বুঝেছিলাম ভাল ফুটবলার হলেই হবে না, গায়ের জোরও মহিষের মতো হতে হবে।”
“সেই দলে কসমসের শুধু পেলেই বিখ্যাত ছিলেন তাই নয়, ওদের কোচ ছিলেন বিশ্বখ্যাত ট্যাকটিসিয়ান ইডি ফিরনি। খেলেছিলেন চিকনালিয়া, টনি ফিল্ডের মতো নামীরাও। ওদের জার্মান কোচ দলকে সাজিয়েছিলেন অদ্ভুত একটা ছকে, ৪-২-৪ ছকে। পিকের ছক ছিল ৫-৩-২। আমাকে বলেছিলেন পেলের পায়ে বল এলেই স্লাইডিং ট্যাকল কররি। আমি তাই করে গিয়েছি ম্যাচে,” জানালেন সুধীর।
গৌতমের একটা আত্মতৃপ্তি রয়েছে। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে লিবেরোর ভূমিকায় ফুটবল সম্রাট পেলেকে তাঁর আসল খেলা খেলতে দেননি।
‘‘কী ম্যাচটাই না আমরা খেলেছিলাম সেদিন। দলের চার ডিফেন্ডারের সামনে আমাকে রেখেছিলেন প্রদীপদা। বলেছিলেন, পেলে-কার্লোস আলবার্তো ওরা নিজেদের মধ্যে ওয়াল খেলে এগোয়, তোকে সেটা ফলো করে ওদের খেলাকে নষ্ট করতে হবে। আমি তো খেলা তৈরি করি, কিন্তু সেদিন আমাকে খেলা ভাঙার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ওটাতেই ক্লিক করে যায় ম্যাচ।’’
কথায় কথায় সত্তরের সেই মিডফিল্ডার ফিরতে চাইছিলেন ১৯৭৭ সালের সেই পেলে ম্যাচে।
“ম্যাচের আগের রাতে সেদিন প্রদীপদা বলেছিলেন, ‘কসমস ক্লাব কিন্তু এখানে বেড়াতে আসছে না। তোমরাও পিকনিকের মেজাজে থেকো না। হারলে সবাই বলবে তোমাদের মুরোদ নেই ওদেরকে মোকাবিলা করার। তোমাদের নিয়ে হাসাহাসি হবে। তারচেয়ে বরং ভেবো নাও ওদের দলে পেলে নেই, একটা সাধারণ দলের বিরদ্ধে খেলতে নামছ। তা হলেই দেখবে নিজেদের খেলা পালটে গিয়েছে। পেলেকেও তোমরা আটকে দিতে পারছ’, জানালেন গৌতম।
তবে সুধীরের হতাশাও রয়েছে। খেলার ৭৩ মিনিটে তাঁর ট্যাকলের কারণেই কসমস সেদিন বিতর্কিত পেনাল্টি পেয়ে ম্যাচে সমতা ফেরায়। না হলে সেদিন মোহনবাগান ম্যাচটি জিতেই মাঠ ছাড়ত।
কোচ পিকে-কে কেন আপনি মনে রাখবেন?
সুধীরের গলা ধরে এল, যেন নিজের বাবাকে আবারও নতুন করে হারালেন।
“প্রদীপদা আমাদের কাছে একটা মিথ। রোভার্সে খেলতে গিয়েছি, ফাইনাল খেলতে নামব মোহনবাগানের বিরুদ্ধে। বাড়ি থেকে মায়ের ফোন। আমাকে বলল, ‘তোর একটা মেয়ে দেখেছি। আমাদের পছন্দ হয়েছে, তুই বাড়িতে ফিরে আয়, তারপর পাকা কথা বলব।’
“ফাইনাল ম্যাচের আগেরদিন এমন কথা শুনে প্রদীপদাকে জানালাম। প্রদীপদা খাবারের টেবিলে সবার সামনে আমাকে বললেন, ‘’ওরে সুধীরের বিয়া হবে, ওকে সবাই উইশ কর।’ আমার তো লজ্জায় মুখ লাল। তারপর আমাকে বললেন, ‘কাল যদি তুই মোহনবাগানকে আটকে দিতে পারিস, আমি কথা দিচ্ছি তোর বউকে আমি আশীর্বাদ করে আসব। কথা রেখেছিলেন প্রদীপদা। আমরা জিতি ম্যাচ ২-১ গোলে। আমি ম্যাচের কার্যত সেরা হয়েছিলাম। প্রদীপদা বিয়েতে আরতি বৌদিকে নিয়ে হাজির থেকে নববধূকে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন।’’
সুধীর ও গৌতম দুজনই বললেন, পিকে-র ম্যাচ পর্যবেক্ষণ ভারতীয় ফুটবলে সবার থেকে সেরা। কাকে দিয়ে কোন কাজটি হবে, তিনি সবচেয়ে ভাল বুঝতেন। তাই তো তিনি ফিফার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে।
“তবে ওই ম্যাচে আরও একটা বিষয় ভুলব না কোনওদিন। পেলের ফ্রিকিক আটকে দিয়েছিল আমাদের শিবাজী। আজ ও আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু গ্র্যান্ড হোটেলের পার্টিতে প্রদীপদা শিবাজীকে বলেছিলেন, এই মুহূর্তে দেশের একনম্বর গোলকিপার তুই-ই। বেশ মনে রয়েছে কথাটা।”
সুধীর কর্মকার